পৃথিবীর বৃহত্তর গ্রাম বানিয়াচং। সাহিত্য সংস্কৃতির এক উর্বরস্থান, ইতিহাস ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ তথ্য ভান্ডার এই বানিয়াচং, জন্মনিয়েছেন বহু জ্ঞানী গুনীজন। তাদের মধ্যে হাফিজ ছিদ্দিক আহমদ তাদেরই একজন। বানিয়াচংয়ে সাংবাদিকতার নাম আসলে যায় নাম প্রথমে আসে তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি, বানিয়াচং প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা তিনি, আমরা যারা আজ সাংবাদিকতা করি অনেকেরই হাতেখড়ি উনার কাছে, বিশেষ করে আমি কৃতজ্ঞ হাফিজ চাচার কাছে আমার সাংবাদিকতার শুরু ওনার মাধ্যমে।
আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তিনি ই প্রথম আমাকে নিয়ে হবিগঞ্জের স্থানীয় প্রত্রিকা হবিগঞ্জের এক্সপ্রেস পত্রিকা শ্রদ্ধেয় সম্পাদক চিন্ময় দা’র কাছে নিয়ে যান এবং আমাকে সেই পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ করে দেন। পরবর্তীতে তিনি আমাকে সিলেটের প্রাচীণ সংবাদপত্র দক্ষিণ এশিয়ার সফল আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক যুগভেরীর তখনকার সিনিয়র সাংবাদিক বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাংবাদিক লেখক মুক্তিযুদ্ধের গবেষক বন্ধুবর অপূর্ব শর্মার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, এই পরিচয়ের সূত্র ধরে আজও অপূর্ব দা’র সাথে খুবই মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান আছে।
হাফিজ চাচা যুগভেরীর শুরুর সময় থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বানিয়াচং প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন, ওনার মৃত্যুর পর আমি যুগভেরীর বানিয়াচং উপজেলা প্রতিনিধি হিসাব কাজ করছি। হাফিজ চাচা কে নিয়ে লিখব সে যোগ্য্যতা আসলে আমার নেই তার পর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ওনাকে নিয়ে লিখা। হাফিজ ছিদ্দিক আহমদ বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়া মহল্লার এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারে ১৯৩০ সালের ১৯ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কারী মমিন উদ্দিন মাতা রহিমা খাতুন ওনারা দুজনই খুবই ধার্মিক লোক ছিলেন।
হাফিজ চাচা কুরআনের হাফিজ ছিলেন তার পর এই জায়গায় থেকে সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও সামাজিকতা করে গেছেন। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক দিয়ে সাংবাদিকতা জগৎ শুরু এরপর আজকের কাগজ ও সিলেটের ডাক সহ বিভিন্ন কাগজের বানিয়াচং প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি বানিয়াচংয়ের সামাজিক বিচার পঞ্চায়েত এক পুরোদা ছিলেন, হাফিজ চাচা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বানিয়াচং শাহী ঈদগাহের সেক্রেটারি হিসাবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
আমরা প্রতিদিন দেখতাম ওনার দোকানে বানিয়াচংয়ের বিশিষ্ট জনদের নিয়মিত আড্ডা বসত, উল্লেখ্য যোগ্যদের মধ্যে ৪নং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজমল হোসেন খান টেনু ১নং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোতাব্বির মিয়া, দেশের পঞ্চায়েত প্রধান ইলিয়াস উল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার আবদুল খালেক সহ দেশ বরেণ্য ব্যক্তিগণ। বানিয়াচংয়ের যে কোন সামাজিক বিচার পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত হাফিজ চাচার দোকান থেকে ই হত। তিনি মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুবই কাছের মানুষ ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামীলীগের বানিয়াচং থানা প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন, হাফিজ চাচাদের মাধ্যমে বানিয়াচং থানা আওয়ামিলীগের যাত্রা শুরু করেছিলন, তখনকার দিনে আওয়ামীলীগ করার মত মানুষ খুবই কম পাওয়া যেত, ঐ সময় আওয়ামী রাজনীতি করতে অনেকে ই উৎসাহিত হতেন না। সাংবাদিককতার পাশাপাশি আওয়ামী রাজনীতির নাম আসলে শ্রদ্ধা ভরে হাফিজ ছিদ্দিক আহমদ চাচা নাম নিতে হয়।
ঐ সময় আওয়ামী রাজনীতি করাতে পাকিস্তান সরকারের পেটুয়া বাহিনীর যন্ত্রণায় ৯ মাস বাড়ির বাহিরে থাকতে হয়েছিল, পরবর্তীতে ৭০ এর নির্বাচনের সময় তিনি ঘরে ফিরেন। বঙ্গবন্ধু যখন হবিগঞ্জ আসলেন তখনকার সময় হাজার হাজার নেতা কর্মীদের মধ্যে নাম ধরে হাফিজ চাচা কে কাছে ডেকে নিয়ে কুশল বিনিময় করেছেন। একবার বঙ্গবন্ধু হবিগঞ্জ সফরে এসেছিলেন তখন জেলার নেতৃবৃন্দ দেখা করতে গেলে ঐ সময় নামাজের ওয়াক্ত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু সহ অন্যরা নামাজ আদায় করেন। ঐসময় বঙ্গবন্ধু হাফিজ চাচার নাম ধরে বলেন, হাফিজ সাহেব আজ আপনি নামাজে ইমামতি করেন, এটা এক বিরল গঠনা।
এই গুনী মানুষ এভাবেই আলো ছড়িয়ে গেছেন আমৃত্যু মানুষের কল্যাণে। একজন সল্পভাষী মানুষ ও গুনীজনের জন আমরা কিছুই করতে পারলাম না। আওয়ামী পরিবার থেকে আজ পর্যন্ত বানিয়াচংয়ে প্রকাশ্যে কোন দিন দেখলাম না একটি শোক সভা করতে এটা ওনার শুভাকাঙ্ক্ষীদের একটি ক্ষোভের বিষয়। আমরা সাংবাদিকরাও দায়ী কম নই, কারন ওনার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আজ পর্যন্ত এমন কিছু ই করিনি আমরা। আমরা যদি আমাদের এই শ্রদ্ধাভাজন জন্য কিছু না করি তা হলে নিজেদের বিবেকের কাছে আমরা দায়বদ্ধ থাকব। হাফিজ ছিদ্দিক চাচা ২০১৮ সালে মার্চের ৮ তারিখ সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ওপারে চলে গেলেন । ওপারে ভাল থাকুন সবার শ্রদ্ধাভাজন হাফিজ ছিদ্দিক আহমদ। প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা।
লেখকঃ আবদুল হক মামুন
সিনিয়র সাংবাদিক বানিয়াচং।