জীবন আহমেদ লিটন, বানিয়াচং থেকে ॥ বৈশ্বিক মহামারী করোনায় পুরো বাংলাদেশ ছিল ৬৬ দিনের লকডাউন ও সরকারী ছুটি। ওই সময়ে সারাদেশের ন্যায় বানিয়াচং উপজেলায়ও করোনা ভাইরাসে সংক্রমন হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে সম্মুখ করোনাযোদ্ধা এসিল্যান্ড মতিউর রহমানও রয়েছেন।
এ মহা সংকটকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উপজেলাবাসীকে সাহস, সচেতনতা, চিকিৎসা সেবা, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করে মানুষের ভালবাসা কুড়িয়েছেন হবিগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ এ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ মামুন খন্দকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বানিয়াচং সার্কেল শেখ মোঃ সেলিম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ মতিউর রহমান খান, সিলেট ক্যান্টনমেন্ট এর ১৭ পদাতিক ডিভিশন ৩২ বীর এর সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আজওয়াদ ফাইয়াজ, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবুল হাদি মোঃ শাহপরান, বানিয়াচং থানার প্রাক্তন অফিসার ইনচার্জ রঞ্জন কুমার সামন্ত, বর্তমান অফিসার ইনচার্জ মোঃ এমরান হোসেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মলয় কুমার, ওসি তদন্ত প্রজীত কুমার দাস ও হাসপাতালের ষ্টাফ নিশাত রহমানসহ অনেকেই।
এডভোকেট আব্দুল মজিদ খান এমপি ২৬ মার্চ থেকেই বানিয়াচং উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে হ্যান্ড মাইক হাতে নিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে সচেতনতামুলক প্রচারাভিযানের পাশাপাশি কর্মহীন ও দরিদ্র মানুষকে দিয়েছেন সরকারী ত্রাণ সহায়তা। তিনি নিজের তহবিল থেকেও সাধ্যমত মানুষকে খাবার সামগ্রী উপহার ও নগদ অর্থ সহায়তা করেছেন।
বানিয়াচং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী দিনরাত ছুটে চলেছেন মানুষের দোরগোড়ায়। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে এবং নিজের জীবনের নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দিয়ে যারপরনাই কষ্ট করেছেন তিনি। টানা ৬৬ দিনে তিনি সচেতনতার পাশাপাশি সরকারী ত্রাণ সহায়তা এবং সঠিকভাবে বণ্ঠন হচ্ছে কি না এর সুক্ষ তদারকি করে তিনি উপজেলাকে রেখেছেন দুর্নীতিমুক্ত। নিজের পরিবারের পক্ষ থেকে শত শত মানুষকে দিয়েছেন খাবার সামগ্রী উপহার ও নগদ অর্থ। তার অবিরাম ছুটে চলায় সাধারণ মানুষ তার প্রতি বেজায় খুশি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মামুন খন্দকার একজন সরকারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে শতভাগ সফলতার খ্যাতি অর্জন করেছেন। টানা ৬৬ দিন তিনি গণজমায়েত ঠেকাতে এবং বাজার স্থিতিশীল রাখতে মোাবাইল কোর্ট পরিচালনার পাশাপাশি চালিয়েছেন প্রচারাভিযান। তিনি সরকারী ত্রাণ বণ্ঠনে অনিয়মের টুটি চেপে ধরায় অন্যান্য উপজেলায় দুর্নীতি হলেও বানিয়াচংয়ে দুর্নীতির বিন্দু মাত্রও ছোঁয়া লাগেনি। তিনি প্রশাসনিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে দাড়িয়ে ভালবাসা কুড়িয়েছেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ মতিউর রহমান খান শুরু থেকেই সরকারী আদেশ জনগণ ও ব্যবসায়ীদের পালনে সচেতন করতে সাহসের সাথে পুরো উপজেলা চষে বেড়িয়েছেন। শুধু বানিয়াচংই নয় তিনি আজমিরীগঞ্জ উপজেলায়ও অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন। তিনি তার সততা ও সাহসিকতা দিয়ে মানুষকে সুরক্ষা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে মানুষের মুখে মুখে করোনাযোদ্ধা খ্যাতি লাভ করেন। তার এ ছুটে চলার মধ্যে এসময় তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন। তিনি প্রায় একমাস চিকিৎসা নেয়ার পর ৩১ মে তিনি বানিয়াচংয়ের অফিসে কর্মে যোগ দেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও বানিয়াচং সার্কেল শেখ মোঃ সেলিম পুলিশ বাহিনীর একজন আদর্শ অফিসার। তিনি করোনা ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন রাতের পর রাত মাঠ চষে বেড়িয়েছেন। রাতবিরাতে বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকেসহ বিভিন্ন যানবাহনে আসা মানুষকে প্রতিরোধ করে বানিয়াচং উপজেলাকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেছেন। আইন শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে তার রয়েছে অনন্য ভূমিকা।
সিলেট সেনা নিবাসের ১৭ পতাতিক ডিভিশন ৩২ বীর এর সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট আজওয়াদ ফাইয়াজ সেনানিবাস থেকে বানিয়াচং আজমিরীগঞ্জ এর সিভিল প্রশাসনকে সহযোগিতার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি একজন পরিশ্রমী ও মেধাবী সেনা কর্মকর্তা। বিরতিহীনভাবে তিনি দুই উপজেলায় মানুষকে সচেতন করতে চষে বেড়িয়েছেন। হ্যান্ড মাইক হাতে নিয়ে তার প্লাটুনকে সাথে নিয়ে যেখানেই হাজির হয়েছেন সেখানেরই গণজমায়েত নিমেষে পন্ড হয়ে যায়। সরকার নির্ধারিত ব্যতির্কে অন্যান্য অসাধু ব্যবসায়ীরা তার বলিষ্ট ভূমিকায় দোকান খোলা রাখতে পারেননি। রাস্তায় মাস্ক ছাড়া কেউ বের হলে তাদেরকে সুমধুর ব্যবহারের মাধ্যমে সচেতন করে তোলার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। তিনি ও তার দল নিজেদের জীবন বাজী রেখে রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার মানুষকে করোনামুক্ত রাখতে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা।
ডাক্তার আবুল হাদি মোঃ শাহপরান করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে কখনও ষ্টেশন ত্যাগ করেননি। তার দুরদর্শী নেতৃত্ব বানিয়াচং হাসপতালের ডাক্তার নার্সসহ সকল পর্যায়ের ষ্টাফরা করোনা রোগী সনাক্ত ও সেবা এবং সাধারণ রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা অব্যাহ রেখেছেন। যা দেশের অন্যান্য উপজেলায় বিরল। অপরদিকে জীবনের ঝঁকি নিয়ে করোনা সেম্পল সংগ্রহ করে মানুষের মাঝে করোনাযোদ্ধা খ্যাতি লাভ করেছেন হাসপাতালের সিএইচসিপি নিশাত রহমান।
বানিয়াচং থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ এমরান হোসেন বানিয়াচং থানায় যোগদান করার পর কয়েকদিনের ব্যবধানে চলে আসে পবিত্র ঈদ। এই ঈদকে সামনে রেখে বহিরাগত জেলার লোকজনকে বানিয়াচংয়ে প্রবেশ রোধে তিনি করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। সারারাত জেগে থেকে তিনি নিজে মাঠ চষে বেড়িয়েছেন এবং তার অধীনস্থদের কাজে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি যোগদান করার পর একটি আলোচিত হত্যাকন্ডের মোটিভ উদঘাটন করে দোষী ব্যক্তিকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছেন।
আর এক করোনাযোদ্ধার কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন বানিয়াচং উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মলয় কুমার। তিনি টানা ৬৬ দিন তার দপ্তরে বরাদ্দকৃত সরকারী ত্রাণ সংরক্ষণ ও সুষম বণ্ঠনে রেখেছেন অগ্রনী ভ’মিকা। ১৫ টি ইউনিয়নে সরকারী ত্রাণ পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বও ছিল তার। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত পরিবারদ্বয়দের বাজার সদাই করে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়া, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা লোকজনের মাঝে খাবার সামগ্রী পৌঁছে দেয়া, ত্রাণ গ্রহনকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা ও সংরক্ষনের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। পবিত্র রমজান মাসে তিনি বাড়ি বাড়ি ইফতার সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। অপরদিকে সরকারের প্রনোদনার জন্য বানিয়াচং উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের ১১ হাজার ৭ শত ৮০ জনের তালিকা সংগ্রহ করে তড়িৎভাবে প্রেরন করেছেন তিনি।
সূত্র জানায় লকডাউন ও সরকারী ছটি ঘোষণার পর ৬৬ দিনে ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে উপজেলায় ২৩ হাজার ৫শত জনকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে ২১ হাজার দুই শত ২৭ জনকে ১০ কেজী করে চাল, ১২ শ জন শ্রমিককে চাল, তেল, ডাল, সাবান উপহার, ৫ শত ৪৪ জনকে চাল ডাল, আলো ও সাবান উপহার, ২৯ জনকে তেল, ডাল আলো এবং ১ হাজার ৩ শত ৬৫ জনকে ৩ লাখ ২৪ হাজার টাকার শিশু খাদ্য হিসেবে দুধ উপহার দেয়া হয়েছে।
অপর একটি সূত্র জানায় বানিয়াচং উপজেলায় ৩১ মে ২০২০ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১২ জন এবং সুস্থ্য হয়েছেন ৬ জন। মোট পরীক্ষা করা হয়েছে ৪ শত ৫৭ জন এবং প্রাপ্ত রেজাল্ট ৪ শত ২৮ জন। হাসপাতালে আইসোলেশনে আছেন মোট ৩ জন।